বাদল দিন আমার খুব অপ্রিয়। শ্রাবণ আগমনের শেষ দিকে আর সারা বছরের রোদ-ছায়ার দিনগুলো আমার বেশ ভালো কাটে। তবে বরাবর এমনটা ছিলাম না আমি। মা বলে ঝুম বৃষ্টির চাইতে হালকা বৃষ্টিতে আশষ্কা অনেক বেশি থাকে। অলস দুপুর আর বাইরে আকাশ ভাঙা কান্নার ধারায় কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম আমি। তখন আমি খুব ছোট, বয়স মাত্র এগারো। তখন আমি চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ি। আমার রোল নম্বর ৭৯। আমি শেষের দিক দিয়ে প্রথম ছিলাম। এইটা ভেবেই মনকে খুশি রাখতাম। আমাকে খারাপ ছাত্র ভাবার কোন কারণ নাই। দশম শ্রেনীর আগে কখনই আমি প্রথম দশ জনের মাঝে ছিলাম না। এর দায় ভার আমাকে না দিয়ে আপনারা আমার বাবাকে দিতে পারেন। আমার প্রতি বছর সর্বনিম্ন দুই বার স্কুল পরিবর্তন করতে হতো। পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবনে আমি ৯ টি স্কুল পরিবর্তন করে ফেলেছিলাম। এ থেকেই বুঝা যায় আমার শিক্ষাজীবন কতোটা রোমাঞ্চকর ছিল। সরকারী কর্মচারী হওয়ায় তাঁকে আমাদের নিয়ে এইখানে ঐখানে ছুটে বেরাতে হত। তাই বছর শেষে আমার রোল নম্বর খাতার উপরের দিকে আসলেও আমার তা উপভোগ করা হতোনা। খাতা-কলমে আমি কোন দিনই ভাল ছাত্র হতে পারি নাই। তবে আমার এই আনন্দ উপভোগ করা না হলেও, আমার পরের সবার খুব ভাল হতো আমার চলে যাওয়াতে। সবাই একধাপ করে এগিয়ে আসতো। আর আমি নতুন জায়গায় আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করতাম। ঋতু পরিবর্তনের মতো আমারও স্কুল পরিবর্তন হতো। এর মাঝেও সবচেয়ে ভাল লাগার ব্যাপার হলো, আমার বই গুলা কখনো পুরোন হতো না। নতুন স্কুলে যাওয়া মানেই নতুন বই।
নতুন বছরের ৩য় মাস যাবে যাবে করছে। হঠাৎ এক বিকালে বাবা এসে বললো, আমাদের আগামী শুক্রবার নতুন শহরে যেতে হবে। বাবার মুখে শুনলাম আমরা একটা মফম্বল শহরে যাচ্ছি। আমাদের জন্য একটা একদম সাধারণ ব্যাপার ছিল। আমার মা কেন জানি সব কিছু গুছায় রেখে দিত। কখন কোথায় যেতে হয়। কোন জায়গায় মায়া জন্মানোর আগেই আমারা ছেড়ে চলে যেতাম। দিনপুঞ্জির পাতা পরিবর্তনের মতো আমাদের শহর পরিবর্তন হতো। নতুন শহর মানেই নতুন কিছুর স্বাদ গ্রহন করা।
মার্চ মাসের ২৩ তারিখ আমরা চলে আসলাম নতুন গন্তব্যে । নবম বারের মতো নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। সব কিছু নতুন। এতো পরিবর্তন আমার বন্ধু বানানোর বিপরীত ছিল। নিজেকে খুব একা একা লাগতো। কারো সাথে মিশতে পারতাম না। একা একা স্কুলে যেতাম আবার একা একা চলে আসতাম বাসায়। কিছু দিনের মাঝেই অনেক অনেক ওলিগলি বের করে ফেলেছিলাম নতুন এলাকার। এর বাড়ির সামনে দিয়ে,ওর বাড়ির পিছন দিয়ে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে স্কুলে যেতাম। আমাদের বাসাটা স্কুল থেকে অনেক দূরে ছিল। হেঁটে যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগতো। তবে বাবার মুখে শুনেছি, বাবারা নাকি দল বেঁধে দুই তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত। এইটা ভেবে তখন নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতো। ঐ রকম হলে হয়তো, আমি অনেক আগেই পড়াশুনার ইতি টেনে দিতাম।
দেখতে দেখতে দুই মাস কেটে গেল। বর্ষাকাল আসবে আসবে করছে। মাঝে মাঝেই ঝুম ধারায় বৃষ্টি শুরু হতো। যেন থামার কোন নামই নাই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি হতো। আর হালকা রিমঝিম বৃষ্টি শীতের দিনের তুষার পরার অনুভূতি নিয়ে আসতো। আশেপাশের ছোট ছোট পুকুর গুলো পানিতে থৈ থৈ করছে। আর সন্ধ্যা হলেই ব্যাঙ এর মধুর ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেত। আমার বর্ষাকাল অনেক প্রিয় ছিল। তবে এখন বৃষ্টি আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। বৃষ্টি আমার প্রিয় জিনিস গুলার মাঝে অন্যতম। বৃষ্টি হবে আর আমি ভিজবোনা এইটা কল্পনার বাহিরে। বৃষ্টি চুম্বকের মতো আমাকে টেনে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে যেত। বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা আমি অনুভাব করতাম। প্রতিটা ফোটা আমার শরীর ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছেয়ে যেত।
অলস দুপুরের আর গভীর রাতের বৃষ্টি আমাকে আনমনে করে দিত। আমি হারিয়ে যেতাম রুপকথার রাজ্যে। বৃষ্টি আমাকে অচেনা ভীন দেশে নিয়ে যেত। যেখানে বৃষ্টির ফোটার শব্দ গুলা মায়াময় সঙ্গীত সৃষ্টি করতো। ভোরের বৃষ্টি পুরো সেই রাজ্যের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুন মিষ্ট সকাল শুরু করতো। যে রাজ্যে ছিল না কোন যান্ত্রিকতা। রাজ্যের মানুষ গুলা বৃষ্টি কে আশীর্বাদ মনে করতো। বৃষ্টি আমাকে বার বার নিয়ে যেত আমার সেই রূপকথার রাজ্যে। বৃষ্টি কখন শেষ হয়ে যেত আমি টেরই পেতাম না। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। কত দিন যে মায়ের কাছে এর জন্য বকা খেয়েছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। সময় গুলার কথা মনে পরলেই আমি এখনও আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
এরই মাঝে রাহুল সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।। পরিচয় বললে ভুল হবে, কিছু দিনের মাঝে সে আমার অনেক ভাল বন্ধু হয়ে গেল। সেও আগে আমার মতো ক্লাসের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকতো। ভদ্র ছেলের যে গুন থাকা লাগে সব ছিল তাঁর। কারো সাথে বেশি কথা বলতো না। কিন্তু আমার সাথে একদম বিপরীত। সারাটা দিন আমরা একসাথে থাকতাম আর গল্প করতাম। কিছু কিছু ব্যাপার আমাদের একেবারে মিলে যেত, যেন মনে হতো সে আমার সব কিছু জেনে আমাকে শুনাতো। তাঁর সাথে পরিচয় হবার পিছনে একটা হাস্যকর কাহিনী আছে। এক বিকালে স্কুল থেকে ফিরবো কিন্তু হঠাৎ মুষুল ধারে বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা দুই জন বাদে সবাই ছাতা নিয়ে এসেছিল। আমরা আটকে রইলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি থামছেই না। স্কুলের পাশেই ছিল বড় বড় কচু গাছ। আমরা দুইটা কচু পাতা কেটে মাথায় দিয়ে বাড়ির পথে হাটা দিলাম। কিন্তু কপাল আমাদের ভাল ছিল না, কিছু দূর যেতেই আমরা একটা পিচ্ছিল জায়গায় একসাথে পরে গিয়ে চাকার মতো ঘুরতে ঘুরতে পচা পানির পুকুরে চলে গেলাম। অনেক কষ্টে উঠে আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমরা “যেমন খুশি তেমন সাজ” প্রতিযোগিতার জন্য সেজেছি। সেই দিন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল। আমাদের দুইজনের বাড়ি খুব কাছাকাছি ছিল। আমরা একসাথে যেতাম আবার ফিরতাম। সময় যেতে লাগলো আর আমাদের বন্ধুত্ব আরও ভাল হইতে থাকলো। আমরা দুষ্টুমিতে যেমন ভাল ছিলাম পড়াশুনাতেও তেমনি। আরও একটা মজার বেপার হল, প্রথম সামযিক পরিক্ষায় আমারা সমান নম্বর পেয়ে যৌথভাবে ২য় হয়েছিলাম।
আমাদের দুই জনের একটা খুব ভাল মিল ছিল। আমরা দুই জনই বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজতাম। বন্ধুত্ব হবার পরে এমন কোন বৃষ্টির দিন নাই যে দিন আমরা ভিজিনাই। আর স্কুলে বৃষ্টি আসলেই সবাই মিলে আমরা ফুটবল নিয়ে নেমে যেতাম মাঠে। কত বার আমাদের স্যার মেরেছে তাও আমারা পরের দিন আবার নেমে যেতাম। আমার আর রাহুলের দিন গুলা খুব ভাল কাটতে লাগলো। কিছু দিনের মাঝেই আমারা সবার অনেক পছন্দের হয়ে গেলাম। মজিদ স্যার মাঝে মাঝেই বলতেন, “এমন একটা শ্রেণী আমি অনেক দিন দেখি নাই। তোদের দেখে আমার অনেক হিংসে হয়। বার বার আমার শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে।”
আমরা অনেক দিন এই শহরে থেকেছিলাম। প্রায় আড়াই বছর। হয়তো আরো কিছু দিন এই খানেই থাকা যেত। কিন্তু উনি আমার জন্য এই শহর ছেড়ে চলে আসলেন। একটা ঘটনা সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। ঐ ঘটনার পরে আমি অনেক চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গিয়েছিলাম। একা একা ঘরের এক কোনে পরে রইতাম। কারো সাথে মিশতাম না। কোন কিছু করতাম না শুধু এক-পলকে এক দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মা বাবা অনেক কষ্টে ছিলেন আমাকে নিয়ে। কারোই মন ভাল থাকতো না। কেউ কারো সাথে কথা বলতো না। কি করে বলবে কথা, আমি যে আমর প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে ফেলছি।
তখন আমরা ৬ষ্ট শ্রেণীর ২য় সাময়িক পরীক্ষা দিয়েছি। স্কুলে রোজার ছুটি চলে। অনেক দিন বন্ধের জন্য কারো সাথে দেখা নাই। মনটা খুব ছটফট করছিল তাদের জন্য। সবাই মিলে ঠিক করলাম আমারা বুধবার সকালে আমাদের সেই চিরচেনা মাঠে ফুটবল খেলবো। সময় ঠিক করার পর থেকে সময় কোন ভাবে পার হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল প্রতিটা ঘন্টা এক একটা যুগের সমান।
ঐ দিন সকালে হঠাৎ করে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। আমার মনটা কেন জানি আগের চেয়েও অনেক ভাল হয়ে গেল। বৃষ্টি আমাকে অন্য সব দিনের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ দিত। সকাল ১০টায় আমরা সবাই একসাথে হয়ে খেলা শুরু করেছিলাম। হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আর মেঘের মুহু মুহু গর্জন। আমাদের খেলা কে এই মেঘের গর্জন থামাতে পারে নাই। আমি আর রাহুল এক দলে ছিলাম। রাহুল অনেক ভাল ফুটবল খেলতো। কিন্তু নিমিশের মাঝে সব শেষ হয়ে গেল। আচমকা একটা বিশাল মেঘের গর্জন, আগুনের মতো গোলা রাহুলের পাশে এসে পরলো। তাঁর নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পরলো। আমরা কিছু সময়ের জন্য নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুহূর্তের মাঝে আমি আমার কলিজার টুকরাকে হারিয়ে ফেললাম। নিজের ভাইকেও এতোটা ভালবাসা যায় না যতটা আমরা দুই জন দুই জনকে ভালবাসতাম। এখনও কিছু একটা নাই অনুভব করি। হয়তো দিনটা অন্য রকমও হতে পারতো।
এর পরও হাজার বার বৃষ্টি এসেছে কিন্তু আমাকে ভিজাতে পারেনি। বৃষ্টি আমাকে আর নিয়ে যায় না আমার রূপকথার রাজ্যে। এখনকার বৃষ্টি গুলা আর আমাকে আনমনে করে না। এখন বৃষ্টি আসলে ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকি। বৃষ্টি কে যে আমার অনেক ভয় লাগে। বৃষ্টি আমাকে বার বার নিয়ে যায় ঐ দিনের স্কুল মাঠে। আমি হাজার বার ভুলতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবার বৃষ্টি এসেছে পুরোন স্মৃতি ভর্তি বস্তা নিয়ে। প্রতিটি বৃষ্টির ফোটা চোখের অশ্রু হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। প্রতিটা বৃষ্টির ফোটা আজ হাজারোও কাব্য গ্রন্থ। বৃষ্টির ফোটা গুলো আজ ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। রঙ গুলো সুখের নয়, শুধুই বিষাদের।