আজ বসন্তের প্রথম দিন। সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদে, বীণা একমনে দাঁড়িয়ে আছে । সন্ধ্যা নেমে আসছে পুরো শহর জুড়ে। আজকের সন্ধ্যাটা অন্য আর পাঁচটা দিনের সন্ধ্যার মতো নয়। এই সন্ধ্যার মাঝে কেমন জানি একটা মায়াবী ভাব আছে। যে কোন উদার মনের মানুষকে সহজেই গ্রাস করে ফেলে তার মনোমুগ্ধকারী আবহয়াওয়া। একটি সুন্দর দিনের পরিসমাপ্তি, একটি সুন্দর সন্ধ্যার মাধ্যমে হয়। এই শহরে সন্ধ্যা নামে বড় বড় অট্টালিকার মাঝে। কয়জনেরই বা ভাগ্য হয় এমন একটা সন্ধ্যা উপভোগ করার। নিচতলার মানুষ গুলো যে বুঝতেই পারে না কখন দিন হচ্ছে আর কখন রাত হচ্ছে। তাদের কাছে সন্ধ্যা যে এক কল্পনার নাম। ছোট বেলার রাজা-রানী এর গল্পের মতো হয় তাদের সন্ধ্যা। তাঁরা কোন দিন মন ভরে উপভোগ করতে পারে না লাল সূর্যের ডুবে যাওয়া। কবি আর সুশীল সমাজ তাদের নিয়ে হাজারও গল্প কবিতা লিখে ফেললো কিন্তু তাঁরা এখনও দেখতে পারলো না রক্তিম সূর্যকে।
বীণা এর মন আজ অনেক ভাল। সবসময় এতো ভাল থাকে না। কেন যে তার মন আজ এতো ভাল সে নিজেও জানে না। হয়তো আজকের আবহাওয়াটাই তার মনকে অনেক ভাল করে দিয়েছে। এক পলকে তাকিয়ে আছে রক্তিম সূর্য এর দিকে। মনে হচ্ছে শহরের আট্টালিকা গুলো নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা করছে কে রক্তিম সূর্যকে গ্রাস করবে। বীণা আনমনে দেখছে বেপারটা, আর ভাবছে যদি আজ সূর্যটা এমন ভাবেই থেকে যেত। কতই না সুন্দর হতো বেপারটা। কৃতিম বাতি ছাড়াই চারিদিকে একটা রক্তিম ভাব থাকতো। কিন্তু প্রকৃতি তো আর বীণা এর ইচ্ছা মতো চলবে না। কিছু সময়ের মাঝেই আট্টালিকা গুলো খেয়ে ফেললো সূর্যকে। বীণা এখনও ঐদিকেই তাকিয়ে আছে আর কি যেন খুঁজার চেষ্টা করছে। হঠাৎ আযানের শব্দে তার ঘোর ভাঙল। এখন বীণা এর নিজের কাছে আবাক লাগছে কিন্তু সে এখনও খুঁজে বের করতে পারছে না, কি ভাবছিল সে। আরও কিছু সময় সে ছাদে থেকে গেল।
ঘরে ফিরেও তার মন এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এখনও বার বার তার মন ফিরে যাচ্ছে বিকালের ঐ ছাদে কাটানো সময়টা তে। এই ভাবতে ভাবতেই নিজের ল্যাপটপ টাকে চালু করলো। নিজের মনের কথা গুলো কারো সাথে বিনিময় করতে না পারা পর্যন্ত তার মন ভাল হবে না। এখন তো আর আগের মতো মনের ভাব চিঠি লিখে প্রকাশ করতে হয় না। এখন ফেসবুক আমাদের মনের ভাব প্রকাশ অনেক সহজ করে দিয়েছে। বীণা অনেক গুলা ছবি তুলেছিল। তার মাঝে থেকে ২ তা ছবি বেছে সবার উদ্দেশ্যে দিয়ে দিলো আর সুন্দর করে ছবির উপরে লিখা,
” এ তল্লাটে সন্ধ্যে নামে অট্টালিকার ফাঁকে
প্রবাহিত বিকেল ছুটি নেয়,
নিমগ্নতার সুরে। ”
কিছু সময়ের মাঝেই অনেক গুলা ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ চলে আসলো। কমেন্টের মাঝে অনেক অনেক বিস্ময়কর চিহ্ন। হয়তো তারও এমন সন্ধ্যা কোন দিন উপভোগ করেনি। মানুষের উত্তর দিতে দিতেই বীণার অনেক সময় কেটে গেল। এখন পড়াশুনার তেমন চাপ নাই। বীণার পড়াশুনার কেমন চাপ তা পরীক্ষার আগে বুঝা যায়। পরীক্ষার আগে বীণার নিঃশ্বাস নেবার সময় থাকে না। খাবার খাওয়া তো অনেক দূরের বেপার। কেউ জানতে চাইলে হেসে হেসে বলে পরীক্ষার আগে আবার কিসের খাওয়া-দাওয়া।
বীণার একটা ভাল অভ্যাস আছে। সে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আগামী দিনের সব কাজের লিস্ট করে ফেলে। এই কাজ করতে যেয়েই প্রতিদিন হতাশ হয়ে যায়। তার কাছে মনে হয়, দিন গুলা অনেক তারাতারি চলে যাচ্ছে। ১০টা কাজের লিস্ট করলেও মোটে ৫/৬ টা কাজ হয়। তবুও সে খুশি কারণ বীণার মনে হয়, লিস্ট করার আগে সে দিনে ৩/৪ টা কাজ করতো। এই সব আজেবাজে ভাবতে ভাবতেই তার মনে হলো কাল তার সকাল ৮ টায় ক্লাস এবং কোন ভাবেই তা বাদ দেওয়া যাবে না। এই ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে সে বলতে পারবে না।
শখের ঘুম নষ্ট করে ক্লাস করতে এসে এখন সে হতাশ। কোন এক অজানা কারণে স্যার আসেননি। পরের ক্লাস ১২ টায়। কি করে এতো সময় কাটাবে এইটা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে লাগলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে বীণার ৪/৫ টা ভাল বন্ধু-বান্ধবি আছে। তারাও এখনও আসেনি। এখন বীণার কাছে ২ টা পথ আছে, হয় ক্যান্টিনে বসে থাকতে হবে, যা বীণার একদমই বাজে লাগে , আর না হয় তাঁকে লাইব্রেরী তে যেতে হবে। কিন্তু তার এখন ঐরকম বিরক্তকর জায়গাতে যেতে কোন ইচ্ছা হচ্ছে না। হঠাৎ তার মনে হলো, আরও একটা পথ আছে, তার পছন্দের জায়গাতে যেয়ে বসে থাকা। জায়গাটা এতো সুন্দর কিন্তু কেউ ঐখানে যায়না। বীণার মনে হয়, হয়তো কেউ এখনও তার সন্ধান পায়নি। জায়গাটা তেমন আহামরি কিছু না। দুইটা ভবনের সংযোগ ব্রিজ। দুই ভবনের ৪র্থ তলায় জায়গাটা। দুই পাশের মৃদু বাতাসের সাথে উপর থেকে দুইপাশের পরিবেশ দেখলে, বীণার মনে হয় সে এখন কোন পাহাড়ের উপরে বসে আছে। এই জায়গার সবচেয়ে বিরক্ত কর বেপার হচ্ছে মানুষের হা করে তাকিয়ে থাকা। যাওয়ার সময় এমন ভাবে তাকায় থাকে যেন এক অসহায় মানুষ বসে আছে, যা বীণার কাছে একদমেই পছন্দ না।
হঠাৎ বীণার মোবাইলে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসল। কল কেটে গেল কারণ অচেলা নম্বর থেকে আসা কল সে ধরে না । আবার একই নম্বর থেকে কল। এইবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে ধরলো। ধরে সে চুপ করে থাকলো, কে তা বুঝার জন্য। একটা মেয়ের কণ্ঠ ভেসে আসছে। ২ টা লাইন শুনেই সে বুঝতে পারলো অপর পাশের মেয়েটা রুপা। কথার মাঝে কেমন জানি উৎকণ্ঠার ভাব। রুপা ছোটো কিছুতেই বেশি বেশি করে ফেলে। এই কারণে বীণা বেপারটাকে সহজ ভাবে নিলো। কারণ জানতে চাইলে রুপার একটাই কথা দেখা করে বলতে হবে। তাই আর কিছু করা নাই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে শান্তির জায়গাটা ছেড়ে উঠতে হল বীনাকে। বেপারটা যেমন ভেবেছিল আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মেয়েটা কোন দিন ঠিক হবে না মনে মনে ভাবতে থাকলো, আর আক্ষেপ করতে লাগলো কলটা ধরার করণে।
বীণা একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এখন রুপার সাথে যেতে হবে পিঠা উৎসবে। মাঠের একপাশে অনেক গুলা প্যান্ডেল করে পিঠা উৎসব হচ্ছে। বীণা পিঠা উৎসবে এসে তো অবাক। এতো রকমারি পিঠা আগে কোন দিন সে দেখেনি। পিঠা গুলা দেখতে যেমন আজব, নামও তেমনি আজব। জুনিয়ারদের জোরাজোরিতে দুই-তিনটা পিঠা খাইতে হল বীণাকে। খাওয়ার পরে সে বুঝল দেখতে সুন্দর হইলেই তা সুস্বাদু হয় না। “চকচক করলেই সোনা হয় না” বেপারটা তেমন।
ক্লাস শেষ হতে হতে ৪টা বেজে গেল। কিছু দিন হলো সবাই মাঠের পাশে পুকুর পাড়ে আড্ডা দেয়। বীণাও গিয়েছে ২/১ দিন। তাঁরা সবাই ২য় বর্ষের, প্রথম দিকে তেমন কথা হতো না বীণার সাথে কিন্তু এখন সবার সাথে কথা হয়। বসন্তের বিকালে আড্ডা দিতে ভালই লাগে। চারিদিকে কেমন জানি আনন্দের আমেজ। কিছু দিন আগেই চলে গেছে বসন্ত বরণ উৎসব। সবাই মিলে ভালই মজা করেছে। ঐটা নিয়েই আজ কথা হচ্ছে। ১০-১২ জনের মতো মানুষ হয়েছে কিন্তু তাদের কথা আর হাসি, ২০-২৫ জন মানুষকেও হার মানাচ্ছে। আড্ডার মধ্যমণি রাসেল আর প্রিয়া। এরা সবাইকে মাতিয়ে রাখে। বীণার মনে হয়, এদের গল্পের ভাণ্ডার কোন দিন শেষ হবে না। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বীণা তাকিয়ে থাকে তাদের দুইজনের দিকে। সবাই তাদের নাম দিয়েছে “গল্পের ডিব্বা”।
হঠাৎ করেই বীণার চোখ গেল আকাশের দিকে। আজকের আকাশটা গতকালকের আকাশকেও হার মানায়। কালো মেঘের ছিটেফোটাও নাই। আসীম নীল আকাশের মাঝে শুধু সাদা মেঘের বিচরণ। এ এক দক্ষ চিত্রশিল্পীর নিপুণ কাজ । এক ঝাঁক পাখির অবিরাম দল বেঁধে উড়ে যাওয়া, এর সৌন্দর্য হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। তার সাথে রক্তিম সূর্যের মিষ্টি আলো বেপারটাকে আরও মনোরম করে দিয়েছে। বীণা আজও অবাক মনে তাকিয়ে আছে। বসন্তের বিকালে নীল আকাশের মাঝে রক্তিম সূর্যের অপরূপ দৃশ্য যারা দেখেনি, তাদের প্রকৃতির রূপ দেখা এখনও অপূর্ণ।
আজও রক্তিম সূর্যটা ঘুমিয়ে যাবে সুউচ্চু অট্টালিকার ওপারে। হাজারো চোখের ভীরে, আবারো ফিরবে ব্যস্ততার শহরে।